Saturday, 24th May, 2025
Saturday, 24th May, 2025

বাবার ছবি নিয়ে ঘুরে-ঘুরে ক্লান্ত মিম ও লামিয়া

 

বাবার ছবি নিয়ে ঘুরে-ঘুরে ক্লান্ত মিম ও লামিয়া

‘বাবা তো ফিরবেই; তিনি আমাকে রেখে মরতে পারেন না! দিনশেষে চুমু না দিলে তো বাবা ঘুমাতেই পারতো না, সেই বাবা আমাদের রেখে চলে যেতে পারেন না, সবাই তো বলে মারা গেছেন! এটা বিশ্বাস করি না, কেননা ২ মাসেও তো বাবার লাশ খুঁজে পাইনি। আর কেউ মিথ্যা কথা বলবেন না, বাবা বেঁচে আছেন, তিনি ফিরবেন, আমাকে আবারো চুমু দিবেন, আমি চুমু দিলে বাবাও ঘুমাবেন’— বাবাকে নিয়ে এমন আশার কথা শোনালো ছোট্ট শিশু লামিয়া আক্তার (৭)।

কথাগুলো বলার সময় চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা স্বজনরা চোখের পানি সংবরণ করতে পারেননি। সে জাতীয় শোক দিবসে বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে ফুল দিতে না পেরে পদ্মা সেতু থেকে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়া নুরুজ্জামানের দ্বিতীয় কন্যা। সে কাঁচপুর হাফেজ কাজী জালাল উদ্দিন কিন্ডারগার্টেন অ্যান্ড হাইস্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী।

লামিয়া আরও জানায়, বাবা বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসতেন। তার জীবনের গল্প শোনাতেন। তিনি তো আমাদেরও ভালোবাসেন, আদর করেন, প্রতিদিন চকলেট, বিস্কুট, কেক নিয়ে আসেন। বাবা আসবে, আমাদের নতুন ঘর বানিয়ে দিবে। সেখানে নিয়ে যাবেন।

নুরুজ্জামান ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার ডৌহাখলা ইউনিয়নের চুড়ালী গ্রামের মৃত আব্দুল খালেকের পুত্র। জাতীয় শোক দিবসে সরকারি বিধিবিধানের জন্য বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে ফুলের তোড়া দিতে না পেরে ক্ষুব্ধ হয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে প্রচণ্ড ক্ষোভ আর আক্ষেপ জানিয়ে ১৫ আগস্ট দুপুর ২টা ৪০ মিনিটে পদ্মা সেতু থেকে পদ্মা নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

প্রায় ২ মাস পদ্মার পাড়ে ঘুরে-ঘুরে ক্লান্ত মিম আক্তার ও লামিয়া আক্তার। মা মোছা. সফুরা বেগমের সঙ্গে শনিবার (৮ অক্টোবর) বাড়ি ফিরেছে। বড় মেয়ে লামিয়া আক্তার কাঁচপুর হাফেজ কাজী জালাল উদ্দিন কিন্ডারগার্টেন অ্যান্ড হাইস্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী। বাবার বাড়ি চুড়ালীতে ভিটেমাটি নেই; আশ্রয় নিয়েছে নানাবাড়ি ২নং গৌরীপুর ইউনিয়নের সাতুতী গ্রামে। নানা আব্দুল হামিদও মারা গেছেন। এখানেও ওদের কোনো ঘরবাড়ি নেই।

এ প্রসঙ্গে সফুরা বেগম জানান, স্বামীর ইচ্ছা ছিল কিছুদিনের মধ্যেই একটু জমি কিনে ওদের জন্য একটা বাড়ি করবেন। সেই স্বপ্ন পূরণ হলো না। এখন সন্তানদের নিয়ে দুর্বিষহ কষ্টে আছি। ওদের নিয়ে রাত্রিযাপনের মতো আমাদের কোথায় ঠাঁই নেই। আমি এখন গার্মেন্টসে চাকরি নিয়েছি, ওদের মুখে তো ৩ বেলা আহার জোগাতে হবে!

স্বামীর মৃত্যু প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ভিডিওতে আপনারা যা দেখেন, আমিও তা দেখেছি। ওই দিন ভোর ৪টায় উঠে সে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়েছে এরপর ফজরের নামাজ পড়েছে। তবে পুষ্পমাল্য দেওয়ার জন্য টুঙ্গিপাড়ায় যাবেন, সে কথা আমাকে জানায়নি।

পরিবারটির অসহায়ত্বের বিষয়টি স্বীকার করেন ডৌহাখলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এমএ কাইয়ুম। তিনি জানান, নুরুজ্জামান অত্যন্ত অতিদরিদ্র একজন মানুষ ছিলেন।

এদিকে ছেলের এ মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না নুরুজ্জামানের মা হেলেনা বেগম। তিনি দাবি করেন, তার ছেলে মরতে পারে না। বঙ্গবন্ধুর মাজারে ফুল দিতে পারে নাই। মনে ক্ষোভ ছিল। সেজন্য মরে যেতে পারে না। তাকে গাড়ি থেকে নদীতে ফেলে হত্যা করা হয়েছে। কেননা সে তাহাজ্জুতের নামাজসহ ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়ত। আমি এ হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই।

মাওয়া নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির অফিসার ইনচার্জ ওয়াহিদুজ্জামান জানান, ভিডিও ফুটেজে হত্যাকাণ্ডের কোনো আলামত আমরা এখনো পাইনি। লাশ উদ্ধারে পদ্মা সেতুর ৮ নম্বর পিলার থেকে ২৬ নম্বর পিলারের চারপাশে খোঁজ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত লাশ পাওয়া যায়নি।

তিনি আরও জানান, ওই প্রাইভেটকার চালক আজিজুল ইসলাম এবং নুরুজ্জামানের বন্ধু ওমর ফারুককে গ্রেফতার করে আদালতে পাঠানো হয়েছিল। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আদালত তাদের জামিন দিয়েছেন।

নুরুজ্জামান ছিল চার ভাই আর তিন বোনের মাঝে সে তৃতীয়। প্রায় ১৫ বছর যাবত নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর এলাকায় পোশাক কর্মী হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

নুরুজ্জামানের ছোটভাই আবুল কাসেম  জানান, সে মরতে পারে না। তাকে পানিতে ফেলে মারা হয়েছে। জড়িতদের বিচার চাই।

জানা যায়, বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে ফুল দিতে যান পোশাক কর্মী নুরুজ্জামান। সে শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণ করতে না পারায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন ফেসবুকে। ভিডিওতে তিনি বলেন, এখানে (বঙ্গবন্ধুর সমাধি) শুধু দেখলাম মন্ত্রী, মিনিস্টার তারাই শুধু! আর তাদের কিছু লোক আর শুধু প্রশাসন। তারাই কি দেশের সবকিছু? তারাই কি শুধু দেশে ভূমিকা রাখে? আমাদের কি কিছুই ভূমিকা নাই? সরকার নিজে বলেছে, ৮০ শতাংশ অর্থ আয় হয় গার্মেন্টস থেকে। গার্মেন্টস পোশাক শ্রমিকদের শ্রম দিয়ে। তাদের ভূমিকা কোথায় গেল? তাদের অধিকার চাই, তাদের স্বাধীনতা চাই।

ওই ভিডিওর বক্তব্যে আরও তিনি বলেন, আমি সাধারণ একজন মানুষ। আমার কথার দাম দিতেও পারেন, নাও দিতে পারেন। কিন্তু আমি মনে করি, বিষয়টা একদম ছোটখাটো না, বিষয়টা অনেক জটিল। স্বাধীন দেশে আমরা যদি মনের আবেগ প্রকাশ করতে না পারি, দম বন্ধ হয়ে মারা যাওয়ার মতো লাগতেছে। এতকিছু থাকতেও মনে হচ্ছে কিছুই নাই। যেখানে আমার সম্মান নাই, আমার স্বাধীনতা নাই।

ভিডিওতে তিনি বলেন, জাতির পিতা সবার পিতা সমতুল্য। তাই তার ডাকে সবাই সাড়া দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে কিন্তু বন্ধু হিসেবে সম্মান দিতে পারলাম না। ফজরের নামাজ পড়ে বেশি টাকা গাড়ি ভাড়া দিয়ে এসেছি। এ কষ্টের দাম কে দিবে? এ ত্যাগ স্বীকার কার জন্য? জাতির পিতার প্রতি আমাদের ভালোবাসা কি মিথ্যা? নাকি আরও কিছু করে দেখাতে হবে? আমার পিতা শুধু একটি সংসার দেখেছেন। জাতির পিতা সবার সংসার দেখেছেন। পুরো দেশের জন্য জান (জীবন) দিয়েছেন। জাতির পিতার প্রতি আমাদের এই ভালোবাসা কি মিথ্যা? আমার আর বলার মতো ভাষা নাই। কষ্টে আমার বুক ফাইট্টা যাইতেছে

সংবাদটি লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করুন